মুশফিকুর রহমান।।
‘যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু, তাঁর শত্রুর প্রয়োজন নেই’ পুরনো প্রবাদটির সত্যতা আবারও প্রমাণিত হলো। ৯/১১ সন্ত্রাসী হামলার পর কথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে তালেবানদের ক্ষমতা থেকে হটিয়ে পুরো আফগানিস্তান দখল করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের প্রায় দেড় লাখ সৈন্য দেশটিতে মোতায়েন করা হয়। দীর্ঘ ২০ বছর তাঁরা দেশটিতে প্রায় তিন ট্রিলিয়ন ডলারের ব্যায় করে। এত বিপুল অর্থ ব্যায় করার পরও দেশটিতে সত্যিকারের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়। আফগানিস্তান পূনর্গঠন ও দেশটির নিজস্ব সেনাবাহিনী গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ভারত ও ইউরোপীয় মিত্ররা স্বক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ভারত আফগান পূনর্গঠনে বড় ভূমিকা রাখে। এবং আফগানিস্তান পূনর্গঠন প্রক্রিয়া থেকে চীন ও পকিস্তানকে দূরে সরিয়ে রাখতে সফল হয়। আশরাফ ঘানি সরকার যুক্তরাষ্ট্র থেকেও ভারতের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। ঘানির ভারত ঘেঁষা নীতি যুক্তরাষ্ট্র বিরোধীতা না করলেও ভালো চোখে দেখেনি। ট্রাম্প তাঁর শাসনামলের শেষ পর্যায়ে আফগানিস্তান থেকে সরে আসার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। দীর্ঘ দুই দশক আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দখলের পর ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে কাতারের দোহায় এক শান্তিচুক্তির মাধ্যমে দেশটি থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার করতে সম্মত হয় ওয়াশিংটন। এর বিপরীতে আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অংশ নিতে তালেবান সম্মত হয়।
চুক্তি অনুসারে ক্ষমতাসীন আফগান সরকারের সমঝোতার জন্য তালেবান চেষ্টা করলেও দুই পক্ষের মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছর মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্যে পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালাতে শুরু করে তালেবান। মে থেকে অভিযান শুরুর পর সাড়ে তিন মাসের মাথায় ১৫ আগস্ট রাজধানী কাবুলের অধিকার নেয় তালেবান যোদ্ধারা।
আফগানিস্তা প্রশ্নে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু নীতির মিল না থাকলেও মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিন চীন সাগরসহ অনান্য ইস্যুতে অভিন্ন মিল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র কখনও বন্ধুত্বকে বড় করে দেখে না ; তাঁর স্বার্থকেই বড় করে দেখে। তাঁর বড় উদাহরণ আফগানিস্তান। যে তালেবানকে উন্নত প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে পরাশক্তি সোভিয়েট ইউনিয়নের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছিল ; সে তালেবানকে ২০০১ সালে নির্মমভাবে ক্ষমতাচ্যুত করে যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তান দখল করে যুক্তরাষ্ট্র তাঁর স্নায়ুযুদ্ধকালীন দীর্ঘদিনের মিত্র পাকিস্থান থেকে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। দিল্লী-ওয়াশিংটনের বন্ধুত্বের মাখামাখি উপমহাদেশের অনান্য দেশগুলো নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। প্রতিবেশী দেশগুলোতে আতঙ্ক বিরাজ করে। দক্ষিন এশিয়ায় ভারতকে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে মেনে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে ভূরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের আগের নীতি থেকে সরে আসে। বিগত দু‘দশকব্যাপি সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের ইতি টানতে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিন এশিয়া নীতিতে কিছু পরিবর্তন আনেন। প্রথমত, পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার। দ্বিতীয়ত, ভারতকে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ কিছু সুবিধা প্রত্যাহার। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী সদস্য পদের বিরুদ্ধে আপত্তি জানায়। যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তিতে হতাশা প্রকাশ করছে নয়াদিল্লী। কোন রাগ-ঢাক না রেখেই বর্তমান জো বাইডেন প্রশাসন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের স্থায়ী সদস্যপদের বিরোধী। অথচ, বিগত দু‘দশক ধরে ভারতকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ দিতে জোরালো সমর্থন করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তাঁর ইউরোপীয় মিত্ররা। আর আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের মধ্যে দিয়ে এতদিনে ভারতকে দেয়া বিশেষ ‘ব্লেঙ্ক চেক’ও প্রত্যাহার করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের অন্তর্ভুক্তির বিরোধীতা ও আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে দক্ষিন এশিয়া ও আশিয়ানভুক্ত (দক্ষিন-পূর্ব এশিয়া) অঞ্চলে পররাষ্ট্রনীতিতে মারাত্নক হোঁচট খেল ভারত।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভূরাজনীতির কৌশলে তালেবানকে সমর্থন করলে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কারণ, বর্তমান মার্কিন নীতিনির্ধারকরা চাচ্ছে আফগানিস্থানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতেই থাকুন। সেই মতে তালেবানের সঙ্গে দোহা শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সৈন্যদের সামনেই কোন রকম বাধা ছাড়াই তালেবানরা কাবুল দখল করে নেয়। ন্যাটো সৈন্যদের সমর্থন ছাড়া এতো সহজেই কাবুল দখল করতে পারতো না তালেবান।
যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে তালেবান ১৯৯৫ সালে কাবুল দখল করে। ৯/১১ ঘটনার পর ২০০১ সালে আমেরিকা সামরিক শক্তি দিয়ে কাবুলের ‘তালেবান রেজিম’পরিবর্তন করে আজ্ঞাবহ কারজাইকে ক্ষমতায় বসায়। বংশবদ কারজাই ও ঘানি প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে। এত কিছুর পরও যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যহার করে ঘানি সরকারকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
আশরাফ ঘানি ২য় মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে অতিমাত্রায় ভারত নির্ভরতা তাঁর জন্য বিপদ ডেকে আনে।আফগান পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতিতে ভারতের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ঘানির ভারত ঘেঁষা নীতি যুক্তরাষ্ট্র ভালো চোখে দেখেনি।
বর্তমান মার্কন প্রশাসন দীর্ঘ তিন দশকব্যাপি সন্ত্রাস বিরোধীযুদ্ধ থেকে নীজকে গুটিয়ে নিয়ে ‘ইউটার্ন করতে চায়। সিনিয়র বুশ থেকে ট্রাম্প পর্যন্ত এই সময়ে বিশ্বব্যাপি যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের নামে লক্ষ লক্ষ নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করে। ইসরাইলকে রক্ষার নামে যুক্তরাষ্ট্র পুরো মধ্যপ্রাচ্যে সন্ত্রাসীদের দিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে।
২০১৮ সালে সাবেক সিনেটর কট্টর রিপাবলিকান নেতা প্রয়াত জন ম্যাককেইন তাঁর ব্যক্তিগত পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমরা ইরাকের মতো আফগানিস্তানে জয়লাভ করতে পারব না।’ ন্যাটো বাহিনীর দ্রæত সরে যাওয়াই উত্তম। জন ম্যাককেইন আরও বলেছিলেন, ‘আমরা আফগানিস্তানে পরাজিত হচ্ছি।’
লেখক: সাংবাদিক।